ব্রিটিশ যুগে তিনি সূর্য সেনের সঙ্গী। আবার ষাটের দশকে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছেন কলকাতা পুলিশকে। তাই আজও তাঁর পরিচিতি কোথাও বিপ্লবী হিসাবে, কারও কাছে তিনি ডাকাত। তিনি অনন্ত সিং।
পড়াশোনার থেকে খেলাধুলা ও শরীরচর্চায় বেশি আগ্রহ ছিল ব্যাবসায়ী পরিবারের ছেলের। মিউনিসিপ্যাল স্কুলে পড়ার সময় নজরে আসেন সূর্য সেনের। মাস্টারদা চিনেছিলেন আগুনকে। বুঝেছিলেন গড়ে নিলে ব্রিটিশদের ঘুম কেড়ে নেবে। হয়েওছিল তাই। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলন দিয়ে অনন্ত সিংয়ের রাজনৈতিক জীবন শুরু। মনে প্রানে মানতেন শুধু প্রতিবাদে নয়, পালটা মার দিতে হবে। প্রথম রণে নামেন ১৪ ডিসেম্বর ১৯২৩।ওই দিন দিনের বেলায় ট্রেজারি থেকে আসাম বেঙ্গল রেল কোম্পানির মাইনে নিয়ে যাবার সময় আরও তিন সহযোগীর সঙ্গে লুঠ করেন সেই টাকা। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যান সনদ্বীপে, সেখান থেকে কলকাতা। পরে ধরা পড়ে চারবছর জেল হয়। মুক্তি পাওয়ার পর চট্টগ্রামে ফিরে কুস্তির আখড়া খোলেন। সেখানে কুস্তির আড়ালে স্থানীয় যুবকদের স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতেন স্বয়ং সূর্য সেন। ১৮ এপ্রিল,১৯৩০। মাস্টারদার পরিকল্পনায় চট্টগ্রামে শুরু হলো যুব বিদ্রোহ। শহরের সামরিক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলোতে একসঙ্গে আক্রমণ করে একদল যুবক। অস্ত্রাগার লুঠ করে সেখানে ধরিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
এই ঘটনার সময় দুর্ঘটনার শিকার হন হিমাংশু সেন। আগুন জ্বালাতে গিয়ে নিজের গায়েই আগুন ধরে যায়। হিমাংশুকে শহরের দিকে নিয়ে যাবার সময় এক মারাত্মক অ্যাকশন হয় পুলিশের সঙ্গে। ফেণী স্টেশনে অনন্ত মুখোমুখি হন পুলিশের। দুই হাতে রিভলবার চালিয়ে পুলিশের জালে কেটে বেরিয়ে যান।২৮শে জুন, ১৯৩০। হঠাৎ কলকাতা পুলিশ কমিশনারের দফতরে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন অনন্ত। বলা হয়, জেলবন্দী চট্টগ্রাম বিপ্লবীদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার বন্ধ করতেই তাঁর এই সিদ্ধান্ত ছিল। বলা হয় বিপ্লবীর শর্তই ছিল অস্ত্রাগার লুন্ঠনে ধৃত বিপ্লবীদের ফাঁসি দেওয়া যাবে না। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে আন্দামানে যান অনন্ত। বন্দীদের সাথে নিকৃষ্টতম আচরণের জন্য জেলে গণ অনশনে সামিল হন। সেলুলার জেল বন্ধ হয়ে গেলে ১৯৩৮ সালে দেশে ফিরিয়ে এনে তাকে আলিপুর জেলে বন্দী করে রাখা হয়। বন্দী অবস্থায় আকৃষ্ট হন মার্ক্সবাদে। ১৯৪৬ সালে আগষ্ট মাসে মুক্তি পেয়ে যোগ দেন কম্যুনিস্ট পার্টিতে।
দেশ স্বাধীন হবার পর নিজেকে প্রত্যক্ষ রাজনীতির থেকে দুরে রাখেন। নকশাল আন্দোলন শুরু হবার ঠিক আগে কলকাতায় একটি দলের উত্থান হয়। নাম ‘রেভ্যুলেশনারি কম্যুনিস্ট কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া’, এজেন্ডা ছিল ‘ম্যান – মানি – গান’। এই সময় কলকাতায় একের পর এক ব্যাংক ডাকাতি হয়। ১৯৬৮ সালের পয়লা জুলাই পার্ক স্ট্রিট পোস্ট অফিসে হানা দেয় অনন্তের বিশাল দল। ৩.৯৭ লক্ষ টাকা ডাকাতি করে তারা। এরপরের নয় মাসে আরও তিনটি বড় ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে ওই দল। এর মধ্যে দুটি ছিল আলিপুরের ন্যাশনাল অ্যান্ড গ্রিডলিজ ব্র্যাঞ্চ। অপরটি ছিল এসবিআইয়ের পার্কস্ট্রিট শাখা। লুঠ করে ১২ লক্ষ টাকা।
তদন্তে নেমে গোয়েন্দা প্রধান দেবী রায় আবিষ্কার করেন এর পেছনে রয়েছে অনন্ত সিংয়ের মাস্টার প্ল্যান। তিনি রেভ্যুলেশনারি কম্যুনিস্ট কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া’র জন্য আন্দোলনের টাকা জোগাড় করছিলেন বলে পুলিশের তদন্তে উঠে আস। অবশ্য ততদিনে ফের গা ঢাকা দিয়েছেন চট্টগ্রাম হামলার বিপ্লবী। পুলিশের খাতায় সেই বিপ্লবীই হয়ে গেলেন ডাকাত। ১৯৬৯ সালে ঝাড়খন্ডে যাদুগোড়ার জঙ্গলে থেকে বুড়ো ডাকাত বিপ্লবীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বিচারে দশবছরের কারাদণ্ড হয়, কিন্তু জেলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় ১৯৭৭ সালে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। মাসখানেক পরেই মারা যান বিতর্কিত বিপ্লবী।
সিএনএন ক্রাইম