রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল হাসপাতালের মর্গে আসা মৃত ছয় তরুণীর মৃতদেহ ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে মুন্না ভক্ত নামে এক যুবককে। দেশে প্রথম কোন মৃতদেহ ধর্ষনকারীর ঘটনা সামনে এলো।
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গের লাশকাটা ঘরে মৃত কিশোরীদের ‘ধর্ষণের’ প্রমাণ পাওয়ার প্রেক্ষাপটে সারা দেশের হাসপাতাল মর্গগুলোতে নজরদারি বাড়িয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সিআইডি বলছে, গত বছরের ২৯ মার্চ থেকে চলতি বছরের ২৩ আগস্ট পর্যন্ত অন্তত ছয়জন মৃত তরুনীর লাশ ধর্ষণ করা হয়েছে বলে তারা প্রমাণ পেয়েছে। এই তরুনীদের বয়স ছিল ১১ থেকে ১৭ বছর। আত্মহত্যার পর তাদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে নেয়া হয়েছিল। লাশগুলোর সঙ্গে শারীরিক সঙ্গম করেছিলেন ডোমের সহযোগী মুন্না ভক্ত (২০)। বৃহস্পতিবার (১৯ নভেম্বর) রাতে গ্রেফতার করেছে সিআইডি।
শুক্রবার (২০ নভেম্বর) ঘটনাটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছে সিআইডি। মুন্নার বাড়ি রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের জুরান মোল্লার পাড়ায়। সে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের কোনো কর্মচারী নয়। হাসপাতালের ডোম যতীন কুমারের ভাগ্নে হওয়ার সুবাদে মুন্না সেখানে কাজ করত। মর্গে আসা মরদেহগুলো সে গ্রহণ করত। আত্মহত্যাকারী ওই তরুনীদের লাশ বিকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে মর্গে আনা হয়। তাই পরীক্ষা-নিরীক্ষার এসব লাশ কাটার সময় নির্ধারণ ছিল পরদিন। রাতের বেলা লাশগুলো মর্গে রাখা হতো। মুন্না থাকত সেখানেই। লাশ পাহারার দায়িত্বও ছিল তার ওপর। এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে বিকৃত মানসিকতা চরিতার্থ করত মুন্না। শুধু তাই নয়, মর্গের ভেতর ইন্টার্ন ডাক্তারদের ক্লাসও নিত মুন্না। সিআইডির সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
এদিকে শুক্রবার সন্ধ্যায় মুন্না আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। জবানবন্দিতে অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের কথা স্বীকার করলেও সে কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত নয় বলে জানায়।
মুন্না বলেছে, রাতে মর্গে সে একাই থাকত। নিরিবিলি পরিবেশ এবং কোনো লোকজন না থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে। তার ভাষায়, মৃত মানুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক দোষের কিছু না। তবে সিআইডি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মুন্না যে অপরাধ করেছেন সেজন্য তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।
জানতে চাইলে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রেজাউল হায়দার বলেন, বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম ধরা পড়েছে। প্রযুক্তির কল্যাণে একটি হাসপাতাল মর্গের ঘটনা ধরা পড়েছে। সারা দেশের অন্য হাসপাতালগুলোতেও অনেক ডোম কাজ করেন। তারা যে এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে না সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। খুঁজলে আরও অনেক পাওয়া যেতে পারে। তাই অন্যান্য হাসপাতালে সিআইডির নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, সিআইডি ফরেনসিক ল্যাবের ডিএনএ ডাটাব্যাংকে সংরক্ষিত ৩০ হাজারের বেশি প্রোফাইলের মধ্যে ছয় হাজারের বেশি প্রোফাইলের ক্ষেত্রে এখনও অপরাধী শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এসব প্রোফাইলে মুন্নার মতো অপরাধী আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে কাউকে সন্দেহ হলে তার ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে প্রোফাইল তৈরি করে সংরক্ষিত প্রোফাইলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে। এ ক্ষেত্রে মিল পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনা হবে।
সিআইডি সূত্র জানায়, বেশ কয়েকটি তরুণীর অপমৃত্যুর ঘটনায় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ থেকে হাই ভেজাইনাল সোয়াবে (এইচভিএস) সিআইডির ডিএনএ ল্যাবে পাঠানো হয়। উদ্দেশ্য ছিল মৃত্যুর আগে ওইসব তরুণী ধর্ষিত হয়েছেন কিনা তা জানা। চলতি বছর ছয় মাসে মোহাম্মদপুর ও কাফরুল থানার অন্তত ছয়টি ঘটনায় পুরুষ বীর্যের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এ আলামতের পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ প্রোফাইল একই ব্যক্তির বলে প্রমাণিত হয়। একের পর এক তরুণীর শরীরে একই ব্যক্তির ডিএনএ নমুনা দেখে চমকে ওঠেন ডিএনএ ল্যাবের কর্মীরা। ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে তৎপরতা শুরু করেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, প্রথমে আমাদের সন্দেহ হয়- এটা কোনো সিরিয়াল কিলারের কাজ হতে পারে। ধর্ষণের পর ওই কিশোরীদের হত্যা করা হতে পারে। অথবা ধর্ষণের অপবাদ সইতে না পেরে তারা আত্মহত্যা করেছেন। এ কারণে আমরা খোঁজার চেষ্টা করি- ওইসব তরুনীর শরীরে বলপ্রয়োগজনিত কোনো আঘাতের চিহ্ন আছে কিনা। কিন্তু অনুসন্ধানে কোনো আঘাতের চিহ্ন বা মৃত্যুর আগে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। তাই মর্গকে ঘিরেই আমাদের সন্দেহ তৈরি হয়। মর্গে কর্মরত ডোমদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করি। অন্য ডোমদের জিজ্ঞাসাবাদ করা অবস্থায় ধর্ষক মুন্না ভক্ত বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ঘটনাস্থল থেকে পলায়ন করে। এতে তার প্রতি আমাদের সন্দেহ প্রবল হয়। এ প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার সিআইডি পরিদর্শক জেহাদ হোসেন বাদী হয়ে মুন্না ও তার অজ্ঞাতনামা সহযোগীদের বিরুদ্ধে শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা করেন। ওইদিন রাতেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তার কাছ থেকে সংগ্রহ করা ডিএনএ আলামত পরীক্ষা করা হয়। এ আলামত ডিএনএ ল্যাবে থাকা আলামতের সঙ্গে মিলে যায়।
মামলার বাদী পুলিশ পরিদর্শক জেহাদ হোসেন জানান, মুন্না চার বছর ধরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল মর্গের লাশকাটা ঘরে কাজ করে। ঢাকায় তার থাকার জায়গা নেই। সে মর্গেই থাকে। লাশকাটা ঘরেই ঘুমায়। যেসব মৃত তরুণীকে সে ধর্ষণ করেছে তাদের বয়স অনূর্ধ্ব ২০। ভালো লাশের দিকেই তার নজর ছিল। আত্মহত্যাজনিত কারণে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদেরই সে ধর্ষণ করেছে। সড়ক দুর্ঘটনা বা অন্যান্য কারণে মৃত্যুর পর যেসব লাশ বিকৃত হয়ে যায় তাদের দিকে মুন্নার নজর ছিল না। তিনি আরও জানান, লাশের ওপর নির্যাতন চালানোর ঘটনায় মুন্নার অজ্ঞাত সহযোগীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।
এ বিষয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গের ইনচার্জ যতীন লাল কুমার বলেন, ঢাকায় মুন্নার থাকার জায়গা না থাকা এবং লাশ পাহারাজনিত কারণে মুন্নাকে মর্গের চাবি দিয়ে রাখা হয়েছিল। সে মাঝে মধ্যে গাঁজা সেবন বা নেশা করত। কিন্তু এ রকম গর্হিত কাজ করবে তা ভাবতেই পারছি না।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান সেলিম রেজা বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকে যারা ডোমের কাজ করেন, তারাই বংশগতভাবে এটি করে যাচ্ছেন। এ কারণে যিনি ডোম হিসেবে নিয়োগ পান, তিনিই তার সহযোগী হিসেবে আত্মীয়স্বজনের দিয়ে কাজ করান।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, দেশে সাধারণ মানসিক রোগীর সংখ্যার চেয়ে যৌনবিকৃত মানুষের সংখ্যা বেশি। মানসিক রোগীরা চিকিৎসকদের কাছে আসেন বলে আমরা জানতে পারি। কিন্তু যৌনবিকৃত রোগীরা জেনেশুনে অপরাধ করেন। তাই চিকিৎসকের কাছে আসেন না। মুন্না ভক্ত যে জঘন্য অপরাধ করে আসছিল, সেটা রোগ হলেও সম্পূর্ণ সচেতনভাবেই একজন অপরাধী এসব করে থাকে।
প্রফেসর অব সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. তাজুল ইসলাম আরও বলেন, কোনও একদিনের অভ্যাসে মুন্না ভক্ত এমন কাজ করেননি। ধীরে ধীরে সে সাহসী হয়ে উঠেছে। প্রথম দিকে হয়তো স্বাভাবিকভাবে মৃতদেহের স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দিতো। পরবর্তীতে আরও ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করেছে। হঠাৎ একদিন এ ধরনের কাজে লিপ্ত হয়। তারপর এটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। ভয়টা কেটে যায়। তারপর থেকে শুধু এই ধরনের যৌনবিকৃত আচারণেই সে সুখ বোধ করে। স্বাভাবিক সম্পর্ক তার কাছে তখন ততটা আনন্দদায়ক হয় না। এই রোগকে আমরা নেক্রোফিলিয়া বলে থাকি। এর বিভিন্ন ধাপ আছে। এটা চূড়ান্ত বিকৃত ধাপ।